৫ মাস ধরে বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় কুয়েট বন্ধ হয়ে আছে। শুধু বাংলাদেশে না পৃথিবীর ইতিহাসে এমন দীর্ঘ বন্ধের ঘটনা বিরল। বিগত বছর গুলোতে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির সংস্কৃতি অতি নিকৃষ্ট ছিল। ছাত্র রাজনীতি মানেই দলবাজি, চাঁদাবাজি, র্যাগিং, ডাইনিং ও ক্যান্টিনে খেয়ে টাকা না দেয়া, এই আর কি। সাধারণ ছাত্রদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে মিছিলে যেতে বাধ্য করা, না গেলে মারধর করা, সরকারের চামচা গিরি করা, ভিন্নমত বরদাস্ত না করা। আবরার হত্যা একটি উদাহরণ মাত্র।
এ কারণে ছাত্র রাজনীতির প্রতি সাধারণ ছাত্রদের ছিল তীব্র ঘৃণা। ৫ আগস্টের পর ছাত্ররা চেয়েছিল ক্যাম্পাসে আর ছাত্র রাজনীতি থাকবে না। চিত্র যখন ভিন্ন হতে থাকে তখন তাঁরা (কুয়েটের ছাত্ররা) প্রশাসনের কাছে রাজনীতি মুক্ত ক্যাম্পাসের জন্য আন্দোলন করে।
কিন্তু ছাত্র নামধারী দুর্বত্তরা রাম দা, পিস্তল, বন্দুক নিয়ে সাধারণ ছাত্রদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। রক্তাক্ত হয় কুয়েট। ১৫০ শিক্ষার্থী আহত হয়। কারো হাড় ভেঙে ৩ খন্ড হয়। পুলিশ প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষক সমিতির তখন ভালো ভূমিকায় ছিল না। ছাত্ররা তখন ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ভিসিবিরোধী আন্দোলন করে ও পদত্যাগের দাবি তোলে। ভিসি ড. মাসুদ যেন মাসুম বান্দা, তিনি পদত্যাগ করবেন না। শিক্ষক সমিতির কিছু স্যার তাঁকে ঢাল হয়ে রক্ষার চেষ্টা করে। ছাত্রদের সাথে হয়তো ঠেলাঠেলি, ধাক্কা ধাক্কি হয়।
ভিসি ড. মাসুদ তাঁর প্রিয়ভাজন কয়েক শিক্ষককে দিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেন। সে কমিটি মূল ঘটনা পাশ কেটে আন্দোলনকারি ৩৭ জন ছাত্রকে বহিষ্কারের সুপারিশ করে। পরে তাদের বহিষ্কার করে আবার প্রত্যাহার করা হয়। যারা রাম দা, বটি, পিস্তল নিয়ে আক্রমণ করল তাদের কিছুই হলো না। ছাত্ররা সে কমিটি প্রত্যাখ্যান করল। ভিসির পদত্যাগের দাবিতে আমরণ অনশন করল।
সরকার ভিসিকে প্রত্যাহার করে নিল। শিক্ষক সমিতি সে শোক সামলাতে না পেরে লাঞ্ছনাকারী! ছাত্রদের শাস্তির দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দেন, যা এখনও চলমান। মাঝখানে সরকার একজন ভিসি নিয়োগ করেন। দুঃখের বিষয় হলেও শিক্ষক সমিতি তাঁর কাছে অন্যায় দাবি করায় (ছাত্রদের বহিষ্কার) তিনি পদত্যাগ করে চলে যান। কুয়েট এখন পর্যন্ত ভিসি শূন্য।
সাধারণ শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন বোনাস বন্ধ। গত কয়েকদিন আগে শিক্ষক সমিতি মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আগে ছাত্রদের বিচার তারপর ক্লাস পরীক্ষা। নতুন ভিসি আসলে তাঁরা তাদের দাবি তুলে ধরবেন। বিচার করেই ছাড়বেন। এ হলো ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা।
এবার ঘটনার বিশ্লেষণে আসি। জানিনা আমার বিশ্লেষণ নিরপেক্ষ হবে কি না।
১ । রাজনীতি মুক্ত ক্যাম্পাস দাবি করা অন্যায়?
২ । দেড় শতাধিক শিক্ষার্থীর রক্ত ঝরল, ভিসি কি দায় এড়াতে পারেন?
৩ । নিজের প্রিয়ভাজন লোক দিয়ে তদন্ত কমিটি করলে সেটা কি নিরপেক্ষ হয়?
৪ । কিছু শিক্ষক ঢাল হয়ে ছাত্রদের কেন রক্ষা করল না? যেভাবে ভিসি ড. মাসুদকে রক্ষা করল?
৫ । যারা ভিকটিম দাবি করছেন তারা নিজেরা তদন্ত করে নিজেরাই বিচার করলে তা কি নিরপেক্ষ বিচার হয়?
৬ । তাদের দাবি অনুযায়ী কিছু শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এখন কি আবার বহিষ্কার করা যাবে?
৭ । যদি আবার বহিষ্কার করা হয় তাহলে আদালতে রিট করলে তা টিকবে? এবং সমস্যা মিটমাট হয়ে যাবে? নাকী আবার ছাত্র আন্দোলন হবে?
৮ । কৃষক শ্রমিক, গার্মেন্ট কর্মী, প্রবাসের রেমিট্যান্স যোদ্ধা যাদের টাকায় বেতন হয় তাদের কাছে কি কোন দায়বদ্ধতা নেই?
৯ । ভিসি ছাড়া কি বিশ্ববিদ্যালয় ২/৪ মাস চলতে পারে না? রুয়েট কিভাবে চললো?
আমাদের দেশে কলেজ ভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্ররা মানসিক ট্রমায় ভোগে। কারণ একাডেমিক প্রেশার, রাজনৈতিক নির্যাতন, পাশের পর অনিরাপদ জীবন, বেকারত্ব, হতাশা, পরিবারের চাহিদা ইত্যাদি। যে কারণে মাঝে মাঝে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে। পাবলিক ভার্সিটিতে বেশির ভাগ দিনমজুর, কৃষক, রিক্সা চালকের সন্তানরা পড়ালেখা করে। উচ্চবিত্তের সন্তানরা অনেক সময় বাইরে পড়ালেখা করে।
এমতাবস্থায় সরকারের নিকট, সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থা, সচেতন নাগরিক, ছাত্র শিক্ষক অভিভাবকের নিকট আবেদন বিষয়টি মানবিকভাবে বিবেচনা করে যার যার অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করে দ্রুত সমস্যার সমাধান বের করতে সচেষ্ট হন।
লেখক : ভূক্তভোগী অভিভাবক ও সহকারী অধ্যাপক, কাদিরদী ডিগ্রী কলেজ, ফরিদপুর।